অ্যান্টিবায়োটিক কখন গ্রহণ করা উচিত এবং কখন নয়, এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর অপব্যবহার থেকে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance)।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার, কিভাবে এটি কাজ করে, কখন এটি কার্যকর নয় এবং অপব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে।
সূচীপত্র
১. অ্যান্টিবায়োটিক কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে?
অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে এমন একটি ঔষধ যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগ নিরাময় করে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে বা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে রোগ সারায়। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত রোগের জন্য কার্যকর, যা ভাইরাসজনিত রোগের জন্য কাজ করে না।
ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের ক্ষুদ্র জীব যা আমাদের শরীরের ভিতরে বা বাইরের পরিবেশে বাস করে। কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের জন্য উপকারী, আবার কিছু ক্ষতিকর হতে পারে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে, যা কখনও কখনও বিপজ্জনক হতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে এটি ব্যাকটেরিয়ার প্রজনন ক্ষমতাকে নষ্ট করে, তাদের কোষের দেওয়াল গঠন বা কার্যপ্রণালীতে বাধা দেয়, ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক সব ধরনের সংক্রমণের জন্য প্রযোজ্য নয়।
২. কখন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত?
অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র তখনই গ্রহণ করা উচিত যখন কোনো সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটিত হয় এবং চিকিৎসক এটি নির্ধারণ করেন। নীচে কিছু সাধারণ পরিস্থিতি উল্লেখ করা হলো যেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কার্যকর হতে পারে:
ক. ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
যখন কোনো সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটে, তখন চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে পারেন। সাধারণ কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ হলো:
- ফুসফুসের সংক্রমণ (নিউমোনিয়া): এটি ফুসফুসের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হতে পারে, এবং এই ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হতে পারে।
- ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI): মূত্রনালীর সংক্রমণ, যা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে।
- টনসিলাইটিস (বিষাকী টনসিলের সংক্রমণ): ব্যাকটেরিয়াজনিত টনসিল সংক্রমণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হতে পারে।
- সাইনোসাইটিস (সাইনাসের সংক্রমণ): যদি এটি ব্যাকটেরিয়াজনিত হয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক সাহায্য করতে পারে।
খ. সার্জারি পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধে
কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রি-অপারেটিভ বা পোস্ট-অপারেটিভ পর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে দেন। সার্জারি চলাকালীন বা পরে শরীরে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে চিকিৎসকের নির্দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
গ. বিশেষ ধরনের সংক্রমণ
বিভিন্ন সময়ে এমন কিছু সংক্রমণ হতে পারে যেগুলো ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটিত এবং অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া এই সংক্রমণ নিরাময় সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, টিউবারকুলোসিস (টিবি) বা ক্যাম্পাইলোব্যাকটর দ্বারা সংক্রমিত ডায়েরিয়া।
ঘ. সংক্রমণজনিত গুরুতর রোগ
কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই ধরনের রোগ যেমন সেপসিস (Sepsis) বা মেনিনজাইটিস (Meningitis) এর ক্ষেত্রে দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।
৩. কখন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয়?
অনেক সময় মানুষ ভেবে নেন যে যেকোনো ধরনের সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর। তবে, এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয় নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে:
ক. ভাইরাসজনিত রোগ
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে, কিন্তু ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়। তাই ভাইরাসজনিত সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। ভাইরাসজনিত কিছু সাধারণ রোগ হলো:
- সাধারণ সর্দি এবং কাশি: সর্দি ও কাশি সাধারণত ভাইরাসজনিত, এবং এই ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো প্রভাব ফেলে না।
- ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা): ফ্লু ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয়, এবং এতে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়।
- কোভিড-১৯: কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট, এবং এর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রযোজ্য নয়।
খ. ভাইরাল ব্রঙ্কাইটিস
ব্রঙ্কাইটিস যদি ভাইরাসজনিত হয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রযোজ্য নয়। ভাইরাল ব্রঙ্কাইটিসের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বিশ্রাম, তরল গ্রহণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদক্ষেপ কার্যকর হয়।
গ. ভাইরাসজনিত গলা ব্যথা
ভাইরাল ফ্যারিঞ্জাইটিসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে কোনো উপকার হবে না। এমনকি এটি ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হওয়া যেকোনো উপসর্গের চিকিৎসায়ও সাহায্য করবে না।
ঘ. রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির ঝুঁকি
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি তখনই ঘটে যখন অ্যান্টিবায়োটিক অযথা বা অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হয়। এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে সাধারণ চিকিৎসায় আর কাজ হয় না। এ কারণে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
(ফলো করুন আমাদের Faceboo এবং Twitter পেজ)
৪. ব্যবহারে সচেতনতা
সঠিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করলে এর মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো যা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে:
ক. চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে চলুন
চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করবেন না। চিকিৎসক পরীক্ষা করে ঠিক করবেন কখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন এবং কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হতে পারে।
খ. পুরো কোর্স সম্পন্ন করুন
অনেক সময় রোগী কিছুটা ভালো অনুভব করলে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ বন্ধ করে দেন, কিন্তু এটি ক্ষতিকর হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পুরো কোর্স সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি।
গ. অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষণ করবেন না
কিছু রোগী অ্যান্টিবায়োটিকের কিছু ডোজ রেখে দেন পরবর্তীতে ব্যবহার করার জন্য, যা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পুরনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
ঘ. ভুল ধারণা এড়িয়ে চলুন
অ্যান্টিবায়োটিক সর্দি, কাশি, জ্বর বা ভাইরাসজনিত অন্য কোনো অসুখের জন্য উপকারী নয়। এ ধরনের ভুল ধারণা থেকে সরে আসতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৫. কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
এ ওষুধ গ্রহণের সময় কিছু নির্দিষ্ট খাবার এবং পানীয় পরিহার করা উচিত, কারণ সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমাতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তুলতে পারে। নীচে কিছু সাধারণ খাবার এবং পানীয়ের তালিকা দেওয়া হলো যেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় এড়িয়ে চলা উচিত:
ক. দুগ্ধজাত খাবার ও দুধ
দুধ এবং দুধজাত খাবার, যেমন চিজ, দই, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পণ্যগুলো অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিকের শোষণ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, টেট্রাসাইক্লিন এবং ফ্লুরোকুইনোলোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা ভালো।
খ. অ্যাসিডিক ফল ও রস
কমলালেবু, লেবু, আঙুরের মতো অ্যাসিডিক ফল এবং এদের রসের উচ্চ অ্যাসিডিক মাত্রা অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে, অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা ইরিথ্রোমাইসিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
গ. আয়রন সমৃদ্ধ খাবার ও সাপ্লিমেন্ট
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন মাংস বা আয়রন সাপ্লিমেন্টও অ্যান্টিবায়োটিকের শোষণে বাধা দেয়। তাই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় আয়রন সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলতে হবে বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।
ঘ. অ্যালকোহল
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় অ্যালকোহল পান করা উচিত নয়। এটি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন মেট্রোনিডাজল, অ্যালকোহলের সঙ্গে গ্রহণ করলে বমি, মাথাব্যথা, দ্রুত হার্টবিট ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঙ. ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা, কফি, সফট ড্রিংকস এবং এনার্জি ড্রিংকসও এড়িয়ে চলা উচিত। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ক্যাফেইনের বিপাক ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, ফলে শরীরে অতিরিক্ত ক্যাফেইন জমা হতে পারে, যা অস্থিরতা এবং মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
চ. হাই ফাইবার খাবার
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার হজমের সময় অ্যান্টিবায়োটিক শোষণের গতি কমাতে পারে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, যেমন সবজি বা গোটা শস্য অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত।
৬. উপসংহার
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু তখনই গ্রহণ করা উচিত যখন চিকিৎসক ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ নির্ধারণ করেন। ভাইরাসজনিত অসুখ বা সাধারণ ঠান্ডা-কাশির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়, বরং এর অযথা ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৭. বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
ক. অ্যান্টিবায়োটিক কি সব ধরনের সংক্রমণের জন্য কাজ করে?
না, অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রে কার্যকর। এটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যেমন সর্দি, কাশি, ফ্লু, বা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কাজ করে না।
খ. অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী এবং এটি কেন বিপজ্জনক?
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা যখন ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর কার্যকর হয় না। এটি বিপজ্জনক কারণ এর ফলে সাধারণ সংক্রমণও জীবননাশক হতে পারে এবং চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়।
গ. অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?
অ্যান্টিবায়োটিকের সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে আছে ডায়রিয়া, পেটের ব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, ত্বকে র্যাশ, এবং কিছু ক্ষেত্রে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া। যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুতর হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘ. কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে গ্রহণ করা উচিত?
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পুরো কোর্স সম্পন্ন করা জরুরি, এমনকি যদি আপনি আগে ভালো অনুভব করেন। এছাড়া, কখনো অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষণ বা অন্য কারো প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গ্রহণ করবেন না।
আরও পড়ুন : ঈদে মিলাদুন্নবী : ইতিহাস, তাৎপর্য ও উদযাপন