যাত্রা করার সময় বিমানের আসন সবচেয়ে নিরাপদ কোনটি, তা নিয়ে অনেক যাত্রীই চিন্তিত থাকেন। বিশেষ করে যখন বিমানের দুর্ঘটনা বা টার্বুলেন্সের মতো পরিস্থিতির কথা মাথায় আসে, তখন এমন একটি আসন নির্বাচন করা যেটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, তা অনেকেরই কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও বিমানের ভ্রমণ বিশ্বব্যাপী অন্যতম নিরাপদ যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত, তবে সুরক্ষা নিয়ে সচেতন থাকা এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে আসন নির্বাচন করা একটি বুদ্ধিমানের কাজ।
সূচীপত্র
- ১. বিমানের ভ্রমণ – সাধারণ নিরাপত্তা
- ২. বিমানের আসনের ধরণ এবং অবস্থান
- ৩. গবেষণা এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিরাপদ আসন
- ৪. কেন বিমানের পিছনের আসনগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ?
- ৫. মধ্যবর্তী আসন এবং এর সুবিধা
- ৬. সামনের আসন: আরাম এবং সুবিধা, কিন্তু ঝুঁকি?
- ৭. বিমানের আসন নির্বাচন: আরও কিছু বিষয় বিবেচনা
- ৮. বিমানের ভ্রমণকে আরও সুরক্ষিত করার জন্য পরামর্শ
- ৯. উপসংহার
- ১০. সাধারণ জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. বিমানের ভ্রমণ – সাধারণ নিরাপত্তা
যদিও অনেকের মনেই বিমান দুর্ঘটনার ভয় রয়েছে, আসলে বিমান যাতায়াত অত্যন্ত নিরাপদ। আধুনিক বিমান সংস্থাগুলো প্রতিনিয়ত সুরক্ষার মান উন্নত করছে, এবং বিমান দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত কম। এক জরিপ অনুযায়ী, প্রতি দশ লাখ ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ০.০৬টি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এর মানে বিমান ভ্রমণ সড়কপথের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। তবুও, যাত্রীরা প্রায়ই জানতে চান, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোন আসন সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারে।
২. বিমানের আসনের ধরণ এবং অবস্থান
বিমান বিভিন্ন ধরণের এবং আকারের হতে পারে, এবং প্রতিটি বিমানের আসনবিন্যাস ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত যাত্রীবাহী বিমানে তিনটি প্রধান আসনের অংশ থাকে:
- সামনের অংশ (Front Section): বিমানের নাকের কাছাকাছি যে আসনগুলো থাকে।
- মধ্যবর্তী অংশ (Middle Section): বিমানের মাঝের অংশ, যেখানে সাধারণত অধিকাংশ যাত্রী বসে থাকেন।
- পেছনের অংশ (Rear Section): বিমানের শেষের দিকে যে আসনগুলো থাকে।
প্রত্যেকটি অংশের আসনই যাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা এবং সুবিধা প্রদান করে, যেমন সিটের আকার, আরামের মান এবং বিমানবালাদের সেবা প্রদানের গতি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুরক্ষার দিক থেকে কোন আসন সবচেয়ে নিরাপদ?
৩. গবেষণা এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিরাপদ আসন
বিভিন্ন গবেষণা এবং পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিমানের পিছনের অংশে বসা যাত্রীরা দুর্ঘটনার সময় তুলনামূলকভাবে বেশি সুরক্ষিত থাকতে পারেন। পশ্চাৎ আসনগুলো (Rear Seats) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিমানের সামনের অংশের তুলনায় দুর্ঘটনার সময় নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। ২০১৫ সালে Time Magazine একটি গবেষণায় প্রকাশ করে যে, বিমানের পেছনের আসনে বসা যাত্রীদের মৃত্যুহার ছিল ৩২%, যেখানে সামনের অংশে বসা যাত্রীদের মৃত্যুহার ছিল ৩৮%।
৪. কেন বিমানের পিছনের আসনগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ?
ক. বিমানের পেছনের অংশে কম প্রভাব পড়ে:
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিমানের পেছনের অংশে সাধারণত কম প্রভাব পড়ে। যখন কোনো বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়, তখন প্রথম আঘাতটি সাধারণত সামনের বা মধ্যবর্তী অংশে লাগে, ফলে পেছনের আসনগুলো কিছুটা সুরক্ষিত থাকে।
খ. বিমানের পেছনের অংশ কাছাকাছি ইমার্জেন্সি এক্সিট:
বিমানের পেছনের আসনগুলো সাধারণত ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি থাকে। যাত্রীদের দ্রুত বিমানের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এই অংশের আসনগুলো সুবিধাজনক হতে পারে।
গ. বিমানের আগুন লাগার ঝুঁকি কম:
বিমানের ইঞ্জিন সাধারণত সামনের বা ডানার কাছাকাছি থাকে, তাই দুর্ঘটনার সময় আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে সামনের বা মধ্যবর্তী অংশে। পেছনের অংশে এই ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
৫. মধ্যবর্তী আসন এবং এর সুবিধা
যদিও পিছনের আসনগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত, তবুও বিমানের মধ্যবর্তী অংশের আসন গুলোরও কিছু সুবিধা রয়েছে। সাধারণত মধ্যবর্তী আসনগুলো বিমানের কেন্দ্রের কাছাকাছি হওয়ায় টার্বুলেন্সের সময় কম ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। এই আসনগুলোতে বসা যাত্রীরা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীলতা অনুভব করতে পারেন।
৬. সামনের আসন: আরাম এবং সুবিধা, কিন্তু ঝুঁকি?
বিমানের সামনের আসনগুলো সাধারণত ব্যবসা শ্রেণি বা প্রথম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত থাকে। এই আসনগুলো আরামদায়ক এবং বেশি জায়গা প্রদান করে। তবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ প্রথম আঘাতটি সাধারণত সামনের দিকে এসে লাগে। ফলে, সামনের আসনে বসা যাত্রীদের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়।
তবে, সামনের আসনগুলোতে আরামের জন্য এই আসনগুলো বেশ জনপ্রিয়। যারা দীর্ঘ ভ্রমণে আরাম এবং ব্যক্তিগত স্থান পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই আসনগুলো ভালো বিকল্প হতে পারে।
৭. বিমানের আসন নির্বাচন: আরও কিছু বিষয় বিবেচনা
যদিও নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে যাত্রীদের আসন নির্বাচন করার সময় আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত। যেমন:
ক. আরাম এবং ব্যক্তিগত স্থান:
বিমানের সামনের আসনগুলো সাধারণত আরামদায়ক হয়, বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির আসন। এগুলোতে বেশি লেগ স্পেস এবং সিটের প্রশস্ততা পাওয়া যায়, যা দীর্ঘ ভ্রমণে আরামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
খ. টার্বুলেন্সের সময় ঝাঁকুনি:
বিমানের মধ্যবর্তী অংশে বসা যাত্রীদের টার্বুলেন্সের সময় কম ঝাঁকুনি অনুভব হয়, কারণ এই অংশটি বিমানের ভারসাম্য বিন্দুর কাছাকাছি। যারা টার্বুলেন্সের ভয়ে ভুগেন, তারা মধ্যবর্তী আসনগুলো পছন্দ করতে পারেন।
গ. ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি আসন:
দুর্ঘটনার সময় দ্রুত বিমানের বাইরে বের হয়ে যাওয়ার জন্য ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি আসন নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ। ইমার্জেন্সি এক্সিটের আসনগুলো যাত্রীদের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে, যেমন দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার সুবিধা।
ঘ. উইন্ডো এবং আইল আসন:
উইন্ডো আসনে বসা যাত্রীরা ভ্রমণের সময় বাইরের দৃশ্য দেখতে পারেন এবং আরাম করে ঘুমাতে পারেন। অন্যদিকে, আইল আসনে বসা যাত্রীরা সহজে উঠতে এবং চলাফেরা করতে পারেন, যা দীর্ঘ ভ্রমণে সুবিধাজনক হতে পারে।
৮. বিমানের ভ্রমণকে আরও সুরক্ষিত করার জন্য পরামর্শ
যদিও আপনি বিমানের কোথায় বসবেন তা কিছুটা সুরক্ষা প্রদান করতে পারে, তবুও নিরাপদ বিমান ভ্রমণের জন্য কিছু সাধারণ পরামর্শ মেনে চলা উচিত:
ক. সিট বেল্ট সবসময় বাঁধা রাখুন:
ফ্লাইট চলাকালীন টার্বুলেন্স বা অন্য কোনো ঝাঁকুনির সময় সিট বেল্ট বাঁধা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিমান সংস্থার নির্দেশিত সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন।
খ. সুরক্ষা নির্দেশনা ভালোভাবে শুনুন:
প্রতিটি ফ্লাইটের শুরুতে বিমানবালারা সুরক্ষা নির্দেশনা প্রদান করেন। এই নির্দেশনা ভালোভাবে শুনে রাখুন এবং কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে কীভাবে সাড়া দিতে হবে তা আগে থেকে জেনে নিন।
গ. জরুরি প্রস্থানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিন:
দুর্ঘটনার সময় দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিমানের জরুরি এক্সিটের অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই জানুন এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কীভাবে বের হতে হবে তা মাথায় রাখুন।
ঘ. হালকা এবং নিরাপদ জিনিসপত্র বহন করুন:
হ্যান্ড লাগেজ বা ব্যাগেজে ভারী এবং বিপজ্জনক জিনিস বহন করা থেকে বিরত থাকুন। এতে করে আপনার নিজস্ব সুরক্ষার পাশাপাশি অন্য যাত্রীদের সুরক্ষাও নিশ্চিত হয়।
৯. উপসংহার
বিমান ভ্রমণ আজকের দিনে অন্যতম নিরাপদ ও দ্রুত যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও দুর্ঘটনার আশঙ্কা খুবই কম, তবুও যাত্রীরা বিমানের আসন নির্বাচন করার সময় নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিমানের পেছনের আসনগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হতে পারে, বিশেষ করে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। তবে, মধ্যবর্তী আসনগুলো টার্বুলেন্সে স্থিতিশীলতা প্রদান করে এবং সামনের আসনগুলো আরামের জন্য জনপ্রিয়।
সব মিলিয়ে, বিমানের আসন যেটাই হোক না কেন, নিরাপত্তার প্রধান শর্ত হলো সিট বেল্ট বাঁধা রাখা, সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলা এবং জরুরি প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত থাকা। নিরাপদ ও আরামদায়ক বিমান ভ্রমণের জন্য এই বিষয়গুলো মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১০. সাধারণ জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
ক. বিমানের পেছনের আসনগুলো কি সত্যিই বেশি নিরাপদ?
হ্যাঁ, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিমানের পেছনের আসনগুলো সামনের এবং মধ্যবর্তী আসনের তুলনায় দুর্ঘটনার সময় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হতে পারে। পেছনের অংশে আঘাতের প্রভাব কম পড়ে এবং এখানে ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি থাকায় দ্রুত বের হওয়ার সুযোগও থাকে।
খ. বিমানের কোন অংশে টার্বুলেন্সের সময় কম ঝাঁকুনি হয়?
বিমানের মধ্যবর্তী অংশ, বিশেষ করে ডানার কাছাকাছি আসনগুলোতে টার্বুলেন্সের সময় কম ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। এই অংশটি বিমানের ভারসাম্য বিন্দুর কাছাকাছি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
গ. ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি আসন কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি আসনগুলো দুর্ঘটনার সময় দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়, যা যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এগুলোতে বসার জন্য যাত্রীর শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে, কারণ জরুরি প্রস্থানে সহায়তা করতে হতে পারে।
ঘ. উইন্ডো আসন নাকি আইল আসন, কোনটি নিরাপদ?
উইন্ডো বা আইল আসনের নিরাপত্তায় বিশেষ পার্থক্য নেই, তবে আইল আসনে বসা যাত্রীরা জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত উঠতে এবং বের হতে পারেন। উইন্ডো আসন থেকে বের হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
ঙ. ব্যবসা শ্রেণি বা প্রথম শ্রেণির আসন কি নিরাপদ?
ব্যবসা শ্রেণি বা প্রথম শ্রেণির আসনগুলোতে আরামের মান বেশি হলেও, সামনের অংশে থাকার কারণে এগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। প্রথম আঘাত সাধারণত বিমানের সামনের অংশে বেশি পড়ে।
(ফলো করুন আমাদের Faceboo পেজ)
আরও পড়ুন :
আখরোট খাওয়ার উপকারিতা, ক্যান্সারও প্রতিরোধ করে
অ্যান্টিবায়োটিক কখন গ্রহণ করা উচিত এবং কখন নয়
টাক মাথায় চুল প্রতিস্থাপন কিভাবে করবেন, কোথায় করবেন
ড্রাইভিং লাইসেন্স করার পদ্ধতি: একটি বিস্তারিত গাইড লাইন